ই-পেপার | বৃহস্পতিবার , ২ মে, ২০২৪
×

রূপময়তায় ঋদ্ধ ভ্রমণকাহিনী

মুগ্ধ হলাম শফিক হাসানের ভ্রমণকাহিনি ‘দেখি বাংলার মুখ’ পড়ে। বাংলাদেশে এ ধরনের ভ্রমণকাহিনি বইয়ের সংখ্যা হাতেগোনা। স্বীকার করতেই হবে। ভ্রমণবিলাসী শফিক হাসান বাংলার পথে-প্রান্তরে ভ্রমণ পরবর্তী রূপসী বাংলার ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর চিত্র কাব্যিক ভাষার উপস্থাপন করেছেন। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে বাংলা শামসুজ্জামান খানকে। উৎসর্গপত্রে শামসুজ্জামান খানের উদ্দেশে বলা শফিক হাসানের কথাগুলো– ‘লোকগবেষক ও যশস্বী এ প্রাবন্ধিক। সবুজ মনের সাক্ষাৎ পেয়েছি একাধিকবার। বিশেষ করে বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পের শিক্ষার্থী থাকাকালীন। তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই বাংলাদেশ দেখার এবং জানার সুযোগ ঘটেছে’। এ থেকে বইটির বিশেষত্ব সহজেই অনুধাবন করা যায়। তাছাড়াও এ বইয়ে কবি আসাদ চৌধুরীর ফ্ল্যাপ বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে।

প্রথম ভ্রমণকাহিনি ‘লালন ও রবীন্দ্র স্মৃতিসান্নিধ্যে’ পড়তে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতা ‘বহু দিন ধরে, বহু ক্রোশ দূরে/ বহু ব্যয় করে, বহু দেশ ঘুরে/ দেখতে গিয়াছি পর্বতমালা/ দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু/ দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে দু’পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপর/ একটি শিশির বিন্দু–মনের কোণে ভেসে ওঠে। শফিক হাসান এ ব্যতিক্রমধর্মী ভ্রমণে বহু ব্যয় করে সিন্ধু দেখতে যাননি। দেখতে গিয়েছেন ঘর হতে দু’পা ফেলে বাংলার চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোতে, যে সব স্থানে একটি ধানের শিষের উপর শিশিরবিন্দু পড়ে। প্রসঙ্গত বলতে হয়, বাংলা একডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পের চতুর্থ ও পঞ্চম ব্যাচের জনা বিশেক শিক্ষার্থীসহ ৪ জুলাই ২০১২ তারিখে শফিক হাসান শিক্ষা সফরে যান। তারা কুষ্টিয়ার শহরতলীর লালনের স্মৃতিধন্য ছেউড়িয়াতে অবস্থিত লালন একাডেমি, রবীন্দ্রনাথের চারণভূমি শিলাইদহের কুঠিবাড়ি, সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুরে রবীন্দ্র কাছারিবাড়ি এবং করতোয়া নদী তীরের শাহ মখদুম মসজিদের নানা স্মৃতিচিহ্ন অবলোকন করে বিমুগ্ধ হন। পদ্মা নদী তাদের বিমোহিত করে, পদ্মা নদীতে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্যাবলিতেও মুগ্ধ হন। এ ভ্রমণকাহিনিতে বিশেষ ঘরানায় সাহিত্যের অনুষঙ্গ তুলে ধরায় সুখপাঠ্য হয়েছে।

লালন-রবীন্দ্রনাথ স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার নানা সাহিত্যিক অনুষঙ্গ। এখানে তিনি সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন কয়েকটি উপশিরোনামে– বাড়ির পাশে আরশিনগর সেথা লালন বসত করে, যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন, গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ, ও আমার দেশের মাটি, এই পদ্মা এই মেঘনা–রবীন্দ্রনাথের চারণভূমির বৈচিত্র্যময়তা। স্বল্প পরিসরে এগুলো থেকে লেখকের দেখা-শোনার ইতিবৃত্ত তুলে ধরলে পিয়াসী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে টিমটিমে আলোয় লালন শাহ ও তার পালক মা মতিজান ফকিরানীর সমাধি দর্শন, লালন একাডেমিতে লালনভক্তদের পরিবেশিত গান–তিন পাগলের হলো মেলা নদে এসে, সামান্যে কি তার দেখা পাওয়া যায়– শুনে কেমন স্মৃতিতাড়িত হয়ে পড়েন তার বর্ণনা বিমুগ্ধ চিত্তে তুলে ধরেছেন ‘বাড়ির পাশে আরশিনগর’ অংশে।

‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’ অংশে গড়াই নদীর ওপারের কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার রবীন্দ্রনাথের পদচিহ্নধন্য শিলাইদহ কুঠিবাড়ির চিত্র অঙ্কন করেছেন অনবদ্য কুশলতায়। জমিদারি দেখাশোনা করার উদ্দেশ্যেই রবীন্দ্রনাথের পদ্মার তীরের শান্ত সমাহিত নির্জন শিলাইদহে আসা। বাংলার পল্লী প্রকৃতির অপূর্ব শ্যামলিমা, পদ্মার রূপমাধুর্যে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে সপরিবারে দীর্ঘ সময় বসবাস করেন। এখানে বসেই রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা, গল্প ও গান।

রবীন্দ্রকুঠি বাড়িতে গিয়ে সফরসঙ্গীসহ লেখকের সাক্ষাৎ ঘটে অন্ধ গায়ক আতিয়ারের সঙ্গে। কবির স্মৃতিবিজড়িত বকুলতলায়। কাছে পৌঁছালেই আতিয়ার গান ধরলেন–‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন, আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে…। শিলাইদহে রবীন্দ্র কুঠিবাড়িকে কীভাবে সাজানো হয়েছে পাঠক এটি পড়লে বুঝতে পারবেন। লেখক তাদের দেখা রবীন্দ্র মঞ্চ, রবীন্দ্র মিউজিয়ামে রাখা কবি’র পালকি, বিভিন্ন ব্যবহার্য জিনিস ও দেয়ালে টানানো ছবির বর্ণনা দিয়েছেন নিখুঁতভাবে। লেখক ও সঙ্গীরা একইভাবে সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর রবীন্দ্র কাছারিবাড়ি সফর করে রীবন্দ্রনাথের স্মৃতিচিহ্নের বর্ণনা তুলে ধরেছেন।

দ্বিতীয় ভ্রমণকাহিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কেওক্রাডং নিয়ে। এ সফর ছিল পাঁচজনের। বলে রাখা ভালো, সমতল ভূমির দেশ বাংলাদেশে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানের পর্বতশৃঙ্গ কেওক্রাডংয়ের উচ্চতা ৪,৩৩২ ফুট। এই পর্বতশৃঙ্গে আরোহণের কাহিনি দুঃসাহসিকতায় ভরা। পাঠক যদি ভ্রমণপিপাসু হন তবে লেখাটি পড়ে বিশেষ তৃপ্ত হবেন।

‘ব্রাত্যজনের ব্রাসেলস (বরিশাল!) যাত্রা’ শিরোনামের ভ্রমণকাহিনিতে লেখকের দুর্নিবার ভ্রমণপিপাসার পরিচয় মেলে। বরিশাল বাংলাদেশের অন্যতম একটি জেলা। অন্য জেলার তুলনায় বরিশাল স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। বরিশাল ধানের দেশ, নদীর দেশ, রূপসীর বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের দেশ। কীর্তনখোলা, ধানসিড়ি নদী কবিতায় বারবার উঠে এসেছে। ভ্রমণপাগল শফিক হাসান ট্রেনে চাঁদপুর, চাঁদপুর থেকে জলপথে লঞ্চযোগে বরিশাল যাওয়ার কাহিনি শুনিয়েছেন। বাড়তি শুনিয়েছেন দ্বীপজেলা ভোলা সফরের গল্প!

‘শেকড়ের সন্ধানে মুজিবনগরে’ ভ্রমণকাহিনি বিশেষভাবে ঋদ্ধ। একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে প্রথম গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার। ওই স্থানকে মুজিবনগর নামে নামকরণ করা হয়। স্বাধীনতা লাভের মাইলফলক হিসেবে মুজিবনগর চিহ্নিত। মুজিবনগরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন ও পরবর্তী পর্যায়ের অনেক অজানা তথ্য লেখক ওই সময়ের মুক্তিযোদ্ধা, প্রত্যক্ষদর্শী, যুদ্ধে ভোগান্তির শিকার মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহ করে তুলে ধরেছেন। ওই অঞ্চলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ও সমাধিফলকের বিষয়গুলোও উঠে এসেছে। এ অংশ থেকে বর্তমান প্রজন্মের পাঠক জানতে পারবেন মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগরের অবদান সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য।

লেখক এই অংশে দর্শনার ইতিহাস খ্যাত কেরু অ্যান্ড কোম্পানির চিনিকল সফরের বর্ণনা তুলে ধরেছেন অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গিতে। বাংলা একাডেমির আয়োজনে চুয়াডাঙ্গা শিল্পকলা একাডেমিতে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সাহিত্য সম্মেলনে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, কবি সৈয়দ শামসুল হক, হায়াৎ মামুদ, রফিকুর রশীদ প্রমুখ লেখক, শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যসেবীদের উপস্থিতিতে যে মিলনমেলার সৃষ্টি তা লেখক অসাধারণ মুগ্ধতায় উপস্থাপন করেছেন, যা বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত বিশ্বের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত। শফিক হাসান কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত সফরের যে বর্ণনা করেছেন তা সমুদ্রসৈকত ভ্রমণপিপাসুদের ভালো লাগবে বলে মনে করি। যারা আজও কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে যাননি তারা এ লেখা থেকে অনুপ্রাণিত হবেন।

মানুষ নিজের দেশের বাইরে ভ্রমণ করতে পছন্দ করে। কিন্তু সেই মানুষই নিজের দেশের সব কয়টি শহর বন্দর গ্রামগঞ্জকে চেনে না। শফিক হাসান ব্যতিক্রম এই অর্থে– দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্পটগুলো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে এবং একাই ভ্রমণ করে সাহসিকতার সঙ্গে সেই ভ্রমণকাহিনি পাঠকের সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন। লেখক চট্টগ্রামে থেকেছেন আগেও, তাই চট্টগ্রাম শহর তার স্মৃতিতে অমলিন। কিন্তু ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ভ্রমণে তিনি চট্টগ্রামকে তুলে ধরেছেন কথা ও ছবিতে অসাধারণ নৈপুণ্যে। তার বন্ধু রিফাত রাসেলের সঙ্গে চট্টগ্রামের দর্শনীয় স্থান ও তাদের চেনাজানা জায়গা পরিদর্শন করেছেন। সেগুলোর মধ্যে প্রীতিলতা মনুমেন্ট, টাইগার পাস, ডিসি হিল, দৈনিক আজাদীর অফিস অন্যতম। এ স্থানগুলো তার চিরচেনা হওয়ায় তা পুনর্বার দেখে যেন নস্টালজিক হয়ে পড়েন, তারই আভাস মেলে।

লেখকের মনে মাদারীপুর বিশেষভাবে দাগ কেটেছিল। ‘মাদারীপুরের স্বর্ণরেণু’ নামে একটি অধ্যায় সন্নিবেশিত করেছেন। এই অধ্যায়ে মাদারীপুরের জেলা সদর, উপজেলাগুলো সফরের বর্ণনা দিয়েছেন সুন্দরভাবে। এই জেলাতেই জন্ম বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ আরও কারও কারও। রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন মাদারীপুর জেলায় ৬টি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য কলেজগুলো সফর করে লেখক তুলে ধরে দেখিয়েছেন শিক্ষাবিস্তারে ওই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবদান। সুচারুরূপে চলার আদ্যোপান্ত।

‘তূর্ণা নিশিথায় নিশিযাপন’ লেখায় তার বন্ধুর চট্টগ্রাম থেকে তূর্ণা নিশিথা ট্রেনে ঢাকায় ফেরায় টিকিট না পাওয়ার বিড়ম্বনার কথা, ট্রেনের টিটিকে টাকা ধরিয়ে দিয়ে চুক্তি মোতাবেক ঢাকায় ফেরার কাহিনি। এসবে পাঠক উপলব্ধি করতে পারবেন রেলওয়ের দুর্নীতির চিত্র।

‘দেখি বাংলার মুখে’ ভ্রমণকাহিনির শেষ গল্প ‘হাতিরঝিল ভেসে যায় জলজোছনায়’। সাহিত্যিক থেকে শুরু প্রকৃতিপ্রেমীরা সুন্দরের আরাধনা করে। সরকার হাতিরঝিলের উপর ফ্লাইওভার বানিয়ে দৃষ্টিনন্দন করেছে। ঢাকা শহরে ইট কাঠ, দালান-কোঠা আর নিয়ন বাতির আলোয় চাঁদের জোছনা ম্লান। হাতিরঝিলে জোছনায় দেখতে গিয়ে লেখক শুনিয়েছেন জলজোছনার গল্প।

পরিশেষে বলতে হয়, শফিক হাসানের রূপসী বাংলার রূপময়তায় ঋদ্ধ ‘দেখি বাংলার মুখ’ বইটি সুখপাঠ্য। পাঠকপ্রিয়তা লাভ করবে আশা করি। ব্যতিক্রমী অনুষঙ্গের রচনার জন্য শফিক হাসানকে জানাই অভিনন্দন।

দেখি বাংলার মুখ
লেখকশফিক হাসান
প্রকাশক : পারিজাত প্রকাশনী
প্রচ্ছদ : জাবেদ ইমন
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১৬

                                                লেখক-মনোজিৎ কুমার দাস : সাহিত্যিক