ই-পেপার | বৃহস্পতিবার , ২৮ মার্চ, ২০২৪
×

‘তালগাছ-কে যেভাবে দুইপায়ে দাঁড়িয়ে রেখেছেন’

কবিতা হলো কবির মাথায় জমে থাকা অতিরিক্ত মেদ! কবিতা কখনও মেদহীন, কখনও প্রাঞ্জল কিছু ভাবনার তরলও বলা যায়। এখনকার কবিতায় সমাজ- সংস্কৃতি, পরিবর্তন -পরিবর্ধন এর শিল্প খুঁজে পাওয়া যায় সহজেই। আবার কিছু কিছু কবির কবিতায় হারানো শিল্পের পথ খুঁজে পাওয়া যায়। জটিল- কঠিনতম ভাষা থেকে বেরিয়ে সরল ভাষায় কবিতার ইমারত তৈরি করে যাচ্ছেন – এ সময়ের ব্যস্ত ও বিদগ্ধ কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল।

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের প্রথম কাব্যগ্রন্থ তৃষ্ণার্ত জলপরী ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল পাঠশালার হাতধরে। একজন আপাদমস্তক সাহিত্যিক হলেও কবিতার প্রতি ভীষণ টান কবির। তথাপি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালকে কবি হিসেবেই বেশি চিনি। অনুবাদ করেন ভিন্ন ভাষার কবিতা- মানে একজন অনুবাদকও তিনি। সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের পরিবার লেখক পরিবার। তাঁর বাবা আলহাজ্ব মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ,সহোদর শিহাব শাহরিয়ার, দুই কন্যা অনাদি নিমগ্ন এবং অর্জিতা মাধুর্যও লেখালেখি করেন। তাদের প্রত্যকের বই রয়েছে। তাঁর প্রকাশিত কবিতা গ্রন্থের সংখ্যা ৭০টির অধিক। সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় অবদান রাখার জন্য তিনি দেশ-বিদেশ থেকে বেশ কিছু পুরস্কারও পেয়েছেন। অতিসম্প্রতি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের শ্রেষ্ঠ কবিতার বইও এসেছে আরেক জনপ্রিয় কবি ও বেহুলা বাংলার প্রকাশক চন্দন চৌধুরীর হাতধরে।

তালগাছ দুই পায়ে দাঁড়িয়ে কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় কবি ও প্রকাশক মাহমুদ নোমান – এর দেয়াঙ পাবলিশার্স থেকে। আধ্যাত্মিকতার কোন একক বা ব্যাপকভাবে সম্মত সংজ্ঞা নেই। আধ্যাত্মিকতায় মিশে থাকে বহুবিদ বিষয়। আধ্যাত্মিকতা কোনো ধর্ম নয়; কিন্তু সকল ধর্মের ভেতরের ধর্মীয় সুফিবাদ, একই সাথে ধর্মের বাইরের দর্শন; পবিত্রতা, শান্তি, কল্যান, ধ্যান, অন্তর্নিহিত চিন্তা, ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞান, আস্তিক- নাস্তিকতার বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতা,ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি, গভীরতম মূল্যবোধ ইত্যাদি বহুমাত্রিক অর্থ ধারণ করে। কবিতার ভেতরেও উল্লেখিত বিষয়গুলো নানাভাবে উপস্থাপিত এবং প্রতিফলিত হয়। এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কবি, যিনি বাংলা কবিতা নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন, তিনি হচ্ছেন — সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল।

আধ্যাত্মিক এবং অন্যান্য কবিতা নিয়ে তাঁর এই কবিতার বই তালগাছ দু’পায়ে দাঁড়িয়ে। তালগাছ দুই পায়ে দাড়িয়ে কবিতাগ্রন্থে মোট ১৯টি কবিতা রয়েছে – সব-কটি কবিতাই ব্যতিক্রম কবিতা। মীথোলজিক্যাল পৃথিবী, পানিফুল, রেপ্লিকা, বিশ্ব উদ্বাস্তু, তালগাছ, তোমারি ওই অমৃতপরশে, শীতঘুম,হাসান আজিজুল হক, মৃত্যিচিন্তা, বাংলা এবং বাঙালি, নদ নদীর লিঙ্গ, মানচিত্র, স্বামী সম্মেলন, ঋণখেলাপি, ভারতীয় রবীন্দ্রনাথ,হিন্দু-হিন্দু খেলা,স্বরেও, গ্রেফতার ও শাদা কিতাব শিরোনামের প্রতিটি কবিতায় রয়েছে আলাদা আলাদা স্বাদ ও চমক। সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের প্রতিটি কবিতায় আমরা ভিন্নতার স্বাদ যেমন খুঁজে পাই তেমনি পাই কবিতায় আধুনিকতার ছোঁয়াও।

যেমন হাসান আজিজুল হক কবিতাটি চোখ বুলাই –

‘হাসান আজিজুল হক আর নেই
খবরটি শোনে আমি বেশ কিছুক্ষণ হাসলাম।

আজ রাত ৯.১৫ মিনিটে তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন!
মনে হলো- হলুদ সাংবাদিকতা!

কেউ মৃত্যুবরণ করলে শোকার্ত মানুষের চোখ ভিজে যায়,
আর আমার হাসি পেলো।’

কবিতা যে পাঠকের ভিতরে প্রবেশ করে ঝড় তুলতে পারে তা আমরা কবির গবেষণালব্ধ কবিতা পাঠে উপলব্ধি করতে পারি।

এবার আমরা তার তালগাছ কবিতাটি দেখি এ কবিতা গ্রন্থের –

‘আমাকে তোমরা তালগাছে তুলে দিয়ে মই নামিয়ে নিলে নাকি আমি নিজেই পাগলের মতো কাছা মেরে
গাছে উঠেছি,
অথবা জ্বীন-পরী ধরেছিলো,
মনে করতে পারছি না।

নিচে প্রচুর মানুষের ভীড়।
তারা চাঁদ দেখার মতো তামশা দেখছে,
পাগল দেখছে,
পাগলের নুনু দেখছে আর বলছে:
বিড়াল কি এমনিতেই গাছে চড়ে, ঠেলায় পড়ে।

নিচে এতো সেনাবাহিনী কেন ?
তারা তীর-ধনুকের মতো বন্দুক তাক করে আছে—
আমি ডরাচ্ছি, ভীষণ ভয় পাচ্ছি
আমার খুব হিসু পাচ্ছে; আমি ভূতের মতো মুতে দেবো!
তালগাছ আমার; আমি আর নামবো না।

নিচে এতো লাখ-লক্ষ টুপি কেন!’

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল-এর কবিতায় সবসময় বৈচিত্র্যময় শিল্পমানসমৃদ্ধ ঘটনা ও স্বাদ থাকে
বাংলা এবং বাঙালি কবিতায় আমরা একপলক দেখি-
বাংলা এবং বাঙালি

‘নাইট কোচে চাটগাঁ যাচ্ছে কাইয়ুম
একটু পর পর সিটের উপরের টং থেকে ব্যাগ খুলে
পানি খাচ্ছে, ঔষধ খাচ্ছে।
পানির ভেতরে জল মেশানো
জল মানে ঔষধ, ঔষধের বোতলে বাংলা।

দেশপ্রেমিক কাইয়ুম গানে গানে গান করে:
‘বাংলা আমার তৃষ্ণার জল, তৃপ্ত শেষ চুমুক
আমি বাংলায় গান গাই
আমি বাংলার গান গাই
আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই’।

একবার শীতকালে বিদেশে ট্রেনিং-এ গিয়েছিলেন
সেখানেও তিনি প্রতুল মুখার্জীর
খাঁটি বাঙালি’ ছিলেন।’

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র একথা সহজেই অনুধাবন করা যায়- তার কবিতাগ্রন্থ পাঠে। নির্ঝর নৈঃশব্দের প্রচ্ছদ ও আল নোমান এর স্কেচে দুই ফর্মার এ কাব্যগ্রন্থের দাম রাখা হয়েছে ১৩০ টাকা। পাওয়া যাবে কলেজস্ট্রিট কলকাতার ইতিকথা বইঘর, রাজধানীর পেন্ডুলাম পাবলিশার্স ও দেয়াঙ পাবলিশার্সে।