ই-পেপার | মঙ্গলবার , ১৯ মার্চ, ২০২৪
×

‘দেশের প্রতিটি সংবাদকক্ষে ফ্যাক্টচেকিং ইউনিট থাকা জরুরি’

আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এজেন্সি ফ্রান্স প্রেসের (এএফপি) ঢাকা ব্যুরো প্রধান শফিকুল আলম বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সব সংবাদমাধ্যমের প্রতিটি সংবাদকক্ষে ফ্যাক্টচেকিং ইউনিট থাকা জরুরি।’ ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) সেন্টার ফর ক্রিটিক্যাল স্টাডিজ (সিকিউএস) আন্তর্জাতিক ফ্যাক্টচেকিং দিবস উপলক্ষে রাজধানীর ধানমন্ডিতে ইউল্যাব গবেষণা ভবনের মিলনায়তনে আজ শুক্রবার বিকেলে বাংলাদেশে ফ্যাক্টচেকিংয়ের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জসমূহ শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন এএফপির ঢাকা ব্যুরো প্রধান শফিকুল আলম।

স্বাগত বক্তব্যে ইউল্যাবের উপাচার্য অধ্যাপক ইমরান রহমান অনলাইনে যুক্ত হয়ে বলেন, ‘ফ্যাক্টচেকিং বিষয়টি আমার অত্যন্ত আগ্রহের। আমি এ বিষয়ে আমার জানাবোঝাকে আরও সমৃদ্ধ করতে চাই। ২০১৭ সালে সিকিউএসের মাধ্যমে অধ্যাপক সুমন রহমান ফ্যাক্টওয়াচ শুরু করেন। আন্তর্জাতিক ফ্যাক্টচেকিং দিবস উপলক্ষে আজ সুন্দর একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সিকিউএস। আসলে মিসইনফরমেশন মোকাবিলায় আমাদের প্রত্যেকের নিজেদের জায়গা থেকে দায়-দায়িত্ব রয়েছে। কিছু শেয়ার করার আগে তা যাচাই করা এবং তথ্যটি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া জরুরি।’

আলোচনা সভার শুরুতে সাংবাদিক শফিকুল আলম বলেন, ‘মিসইনফরমেশন বা ডিসইনফরমেশন একটি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতাকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। সম্প্রতি কুমিল্লার ঘটনায় তথ্য ছড়িয়ে পড়ে, এক গ্রামে হিন্দু মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। টিভির স্ক্রলে চলে এসেছে, ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এদিকে আমিও আমার নিউজরুমে চাপে আছি, তথ্যটা আমাদের নিশ্চিত হওয়া দরকার। সাধারণত নির্ভরযোগ্য হিসেবে পরিচিত লেখক ও সাংবাদিকদের কয়েকজন শেয়ার করেছেন। কয়েকটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমও নিউজ দিয়ে দিয়েছে। কিন্ত শেষমেশ দেখা গেল ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। সারা দেশেই হিন্দু কমিউনিটির লোকজন বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু সেদিন ধর্ষণের ঘটনাটা তো ঘটেনি। পাড়ার নামই কেউ বলতে পারছে না, মেয়েটির নামপরিচয়ও জানা যাচ্ছে না। অথচ ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। একটা গ্রামে দুই তিন ঘর মুসলমান অথবা দুই তিন ঘর হিন্দুর বসবাস। তারা বুঝেছে, পরিস্থিতি কতটা ভয়ানক হতে পারে।’

শফিকুল আলম বলেন, ‘১৯৭৪ সালে রংপুরে বাসন্তীকে নিয়ে সংবাদপত্রে রিপোর্ট হয়েছে। আসলেই বাসন্তী জাল গায়ে দিয়ে ছিলেন কিনা। ১৯৯১ সালের একটি বইয়ে সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন ওই চেয়ারম্যানের একটা সাক্ষাতকার পেলাম, যেই চেয়ারম্যান বাসন্তীকে এনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। একজন যিনি বাসন্তীর ঘটনা বিশ্বাস করেন না, তাঁর সঙ্গে এটা নিয়ে কথা বললাম তিনি মোনাজাত উদ্দিনের ব্যাকগ্রাউন্ড টান দিলেন, বললেন, উনি তো এটা লিখবেনই। দেখেন, পরিস্থিতি খুবই ভয়ানক। বাংলাদেশের ইতিহাসের কোনোকিছু মীমাংসিত নয়। বহু তথ্যের ফ্যাক্টচেকিং দরকার আছে। এসব নিয়ে অনেক কাজ করতে পারব, যদি আমাদের নিউজরুমে ফ্যাক্টচেকিং বিভাগ থাকে। সংবাদকর্মীদের কপি লেখার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হতে হবে। আমি একটি বড় মিডিয়ায় দুই সপ্তাহ কাজ করেছি। সেখানে আমার চোখের সামনে দেখলাম, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিজের মতো করে সংশোধন করছেন। বাক্য সম্পূর্ণ করে দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী হয়তো অর্ধেক বাক্য বলেছেন। তিনি বলতেই পারেন, কিন্তু আমাদের তো তা পূর্ণাঙ্গ করে দেওয়ার কোনো অধিকার নাই। দরকারও তো নাই এমন করার।’

শফিকুল আলম আরও বলেন, ‘২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসল, সারা দেশে হিন্দুবিরোধী ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে। একেক জায়গায় একেক রকম তথ্য পাওয়া যায়। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটা লেখার বরাত দিয়ে দেশের মূলধারার একটা মিডিয়ায় বলা আছে, ৭০০ জন মারা গেছে বা কেউ কেউ দেখি লেখেন যে, ১১ হাজার নিহত হয়েছেে। কোথাও বলা হয়েছে, নিহত সাত হাজার। অন্যদিকে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট দেখলাম। নিউইয়র্ক টাইমসের ওই ঘটনার রিপোর্টে বলছে, ২০ জন নিহত হয়েছে। এটা তাহলে কোনটা সঠিক। এরকম বহু বিষয় রয়েছে। চলমান ঘটনার পাশাপাশি ইতিহাসের অনেক কিছু নিয়ে ফ্যাক্টচেক করার সুযোগ আছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটা ফল্টলাইনে মিসইনফরমেশন নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে। একটার সঙ্গ আরেকটা মিলে না। এমন কোনো জায়গা নাই আপনি এরকম পাবেন না।’

আলোচনা পর্বে এএফপি ফ্যাক্টচেক বাংলাদেশের সম্পাদক কদরুদ্দিন শিশির বলেন, ‘আমাদের দেশের নিউজরুমে সতর্কর্তা কম। সংবাদকর্মীদের মাঝে তথ্য যাচাইয়ের অনলাইন দক্ষতা যোগ্যতারও কিছুটা ঘাটতি আছে। জবাবদিহিতার জায়গাটা শক্ত না। আইন প্রয়োগ করে করা যেতে পারে, কিন্তু এই পথে সমাধানের চিন্তায় ঝুঁকি আছে। আর সংবাদকর্মীদের দিক থেকে যাচাইয়ের তাগিদেও ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। সেই জায়গায় বেশি কাজ করা লাগবে। সম্প্রতি অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট তারকা গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ভারতে বিয়ে করেন, এবং একটি রম্য প্রকাশ হয় তাঁর জুতা চুরি এবং থানায় মামলা করা নিয়ে। অথচ দেশের মূলধারার মিডিয়াগুলো সেটাকে দিব্যি সংবাদ আকারে একেবারে সত্য ঘটনা হিসেবে নিয়ে নিউজ দিয়ে দিল।’

সাবেক মিস ইউক্রেন আনাস্তাসিয়া লেনা যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন বলে একটি ভুয়া খবরের উদাহরণ টেনে কদরুদ্দিন শিশির বলেন, ‘আনাস্তাসিয়ার ইনস্টাগ্রামের বরাতে নিউজ হলো। অথচ সংবাদকর্মীরা ইনস্টা পোস্টটা দেখারও প্রয়োজন মনে করলেন না। আনাস্তাসিয়া ইনস্টাগ্রামে খেলনা অস্ত্র হাতে নিয়ে ছবি পোস্ট করে বলেছিলেন, রুশ সেনাদের সামনে পেলে খতম করতে। সেখানে তিনি নিজের যুদ্ধে যোগ দেওয়ার কথা বলেননি। নিউইয়র্ক পোস্টসহ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম তাদের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে নিউজ করে দিল সে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশে পাঁচ-ছয় দিন পর এই নিউজটি সব মিডিয়া ধরেছিল। অথচ আনাস্তাসিয়া লেনা পরেরদিনই ইনস্টাগ্রামে আরেকটি পোস্টে পরিষ্কার বলেছিলেন, তিনি যুদ্ধে যোগ দেননি। তাহলে বাংলাদেশের সংবাদকর্মীরা যদি একবার ইনস্টাগ্রাম একাউন্টে ঢুকতেন তাই বুঝতেন খবরটি ভুয়া।’

বুম বাংলাদেশের ফ্যাক্টচেকার মিনহাজ আমান বলেন, ‘আইন প্রয়োগ করে আসলে সংবাদমাধ্যমের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা কঠিন কাজ। এর বাইরে আমরা একটা ইকোসিস্টেম তৈরি করতে পারি বিশ্ববিদ্যালয় বা ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক। যার মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমকে এবং একে অপরকে পর্যবেক্ষণে রাখতে পারি। মিডিয়াওয়াচের কাজটা জারি রাখতে পারি। আর দেখেন, ম্যাক্সওয়েলের ঘটনায় আনন্দবাজার পত্রিকা আর আজতক দেখে নিউজ দিয়ে দিচ্ছি। নিউজে না আছে ম্যাক্সওয়েলের বক্তব্য, না আছে তাঁর স্ত্রীর বক্তব্য, থানায় মামলা হয়ে থাকলে পুলিশের বক্তব্য থাকবে সেটিও নেই। এজন্য সংবাদকর্মীদের ইন্টারনেট ব্যবহারের মৌলিক চর্চা বা গুগলিংটা আরও ভালো থাকলে এসব গ্যাপ আরও কমে যেত।’

ফ্যাক্টওয়াচের ফ্যাক্টচেকার শুভাশিস দীপ বলেন, ‘ফ্যাক্টচেকিং কোনো অটোমেটিক পদ্ধতি নয়। কোনো ছবি বা ভিডিও হয়তো লাখ লাখ বার শেয়ার হয়, তাতে এর কোয়ালিটি কমতে থাকে। তখন তার উৎস খুঁজে পেতে কঠিন হয়ে যায়, সময় বেশি লেগে যায়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তথ্যের উৎসের স্বচ্ছতা। নেটওয়ার্কিংও এই কাজের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। হয়তো সাতক্ষীরায় একটা ঘটনা ঘটছে, সেখানে আমার পরিচিত কোনো সাংবাদিক থাকলে তথ্যের বিস্তারিত জানা যায় এবং নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ বেশি থাকে।’

ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানারের প্রধান উপদেষ্টা জাওয়াদ বিন হাফিজ বলেন, ‘প্রতিটি সংবাদমাধ্যমের একটা প্রতিযোগিতার বিষয় আছে, কার আগে কে নিউজটা দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে তথ্যটা যাচাইয়ের সুযোগ কমে বা যাচাইয়ের গুরুত্ব কমে যায়, এখানেই সমস্যাটা দাঁড়ায়। তথ্য যত হাতের নাগালে আসবে তত ভুয়া খবর বেশি ছড়াবে। এ কারণে তথ্যের প্রাপ্যতা কমাতে হবে তা-ও নয়। গত তিন মাসে আমরা প্রায় ২৯০টি গুজব নিয়ে কাজ করেছি। এর মধ্যে প্রতিটি ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান নির্দলীয়। কিন্তু আমাদের মধ্যে একটা ধারণা আছে, সরকারের বিরুদ্ধে হলে সত্য, আর সরকারের পক্ষে গেলে ভুল। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সরকার যে সব সময় ভুল তা নয়।’

আলোচনা অনুষ্ঠানের শেষে সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে সিকিউএসের পরিচালক ও ইউল্যাবের মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের অধ্যাপক সুমন রহমান বলেন, ‘মিসইনফরমেশন মোকাবিলায় নিউজ ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমির মধ্যে আরও সংযোগ জরুরি। এ ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ হতে সংবাদমাধ্যমগুলো যেকোনোভাবে আমাদের সহযোগিতা চাইলে লিবারেল আর্টস ইউনিভার্সিটি হিসেবে আমরা তা দিতে প্রস্তুত। সংবাদকর্মীদের কোনো প্রশিক্ষণের প্রয়োজন মনে করলে আমরা বিনা খরচায় সে আয়োজন করতে রাজি আছি।’

আলোচনা অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা করেন ফ্যাক্টওয়াচের ফ্যাক্টচেকার আপন দাশ। পুরো অনুষ্ঠানের উপস্থাপনায় ছিলেন সিকিউএসের গবেষণা সহযোগী নাসরিন জেবিন।
‘দেশের প্রতিটি সংবাদকক্ষে ফ্যাক্টচেকিং ইউনিট থাকা জরুরি’ প্রতিবেদনটি এনটিভি অনলাইন হতে নেয়া। –

এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত রিপোর্ট