ই-পেপার | মঙ্গলবার , ১৯ মার্চ, ২০২৪
×

কৃত্রিম বালু চর পেয়ে উচ্ছ্বাসিত সরফভাটা তীরের মানুষ

নদী মানবজাতির জন্য আশীর্বাদ, এক সময় যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজ করতে নদীকেন্দ্রিক বসতবাড়ি হত তীরবর্তী এলাকায়। কিন্তু আশির দশকের পর থেকে নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে রাঙ্গুনিয়ায় নদীর অববাহিকায় সরফভাটারসহ কয়েকটি ইউনিয়ন জন্য অভিশাপে পরিণত হয়।

আমরা হারিয়েছি রাঙ্গুনিয়া ঐতিহ্যবাহী বিখ্যাত প্রাচীন বাজার ‘কানুরহাট’ এছাড়া নদীর গর্ভে অর্ধেক বিলীন হয়েছে ১১৭ বছরের দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মোয়াবিনুল ইসলাম মাদ্রাসা। সরফভাটার মানুষের দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নদী ভাঙ্গনের মতো অভিশাপ থেকে মুক্তি পায় ২০০৮ সালে রাঙ্গুনিয়া হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপি মহোদয় নির্বাচনের ঐতিহাসিক জয়ের পর আশীর্বাদ হিসেবে উন্নয়নের প্রদীপ জ্বালিয়েছেন।

গত ২১শে জানুয়ারি (শনিবার) ২০২৩ইং তারিখে বিকাল ৪টায় চট্টগ্রাম রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা ইউনিয়ন ৮নং ওয়ার্ডে কর্ণফুলী নদীর ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় আরসিসি ব্লক রক্ষায় নদী খননকৃত (বর্জ্য) বালি নিক্ষেপ করলে কৃত্রিম চর সৃষ্টি হয় এতে সরফভাটা মোয়াবিনুল ইসলাম মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক ও পূর্ব সরফভাটার নদীর তীরবর্তী বাসিন্দাসহ সহস্রাধিক জনগণ গণমাধ্যমের সামনে সরকারের ও সংশ্লিষ্টদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সময় সরফভাটা ইউপি চেয়ারম্যান শেখ ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী এসব কথা বলেন।

তিনি আরো বলেন, “সরকারের ৩৯৮ কোটি টাকার প্রকল্প বামতীরে আরসিসি ব্লকের মাধ্যমে এ পর্যন্ত পুরোপুরি নদী ভাঙ্গন রোধ করতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি নতুন চরে উপকূলীয় বনের আদলে প্যারাবন সৃষ্টি করতে পারলে চারটির স্থায়িত্ব হবে, ইতোমধ্যে বন বিভাগের সাথে কথা হয়েছে, তারা প্যারাবন করতে আশ্বস্ত করেছেন”।

এই সময় রূপালী রাঙ্গুনিয়া পত্রিকার সম্পাদক, লেখক ও সাংবাদিক এনায়েতুর রহিম বলেন, কর্নফুলী নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে অনেক অধিবাসী রাঙ্গুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছে। খরস্রোতা নদীর বুকে জেগে উঠছে ধূ ধূ বালুচর। সাধারন মানুষজন আনন্দে উচ্ছাসিত, ফিরে পাচ্ছে বাপদাদার পৈতৃকভূমি। পানি উন্নয়ন বোর্ড খননকৃত বালি পুরো ভাঙ্গন উপদ্রুত এলাকায় মওজুদ করলে আগামি বিশ বৎসরে নিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকবেনা। জেলা প্রশাসন মওজুদ বালি অকশনে বিক্রি না করে নদী শাসনে সেই বালি ব্যবহৃত হলে সরকারিভাবে অর্থের সাশ্রয় হবে।

স্হাপনকৃত সাড়ে তিন হাজার ফুট সিসি ব্লকে দীর্ঘ মেয়াদি টেকশই মজবুত প্রোটেকশন তৈরি হবে। সেই সাথে শিলক খালের মোহনার সাথে আর সি সি ব্লক, জিও ব্যাগ (রাবার ড্যাম) বসানো হয় তবে এই চর দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে মনে করি অন্যথায় শিলক খালের তীব্র স্রোতে চরটি বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড রাঙামাটি জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী তয়ন কুমার ত্রিপুরা বলেন, কর্ণফুলী নদীর উভয় তীরেই ১০ কি:মি: নদী ড্রেজিং হচ্ছে। সেখান থেকে উত্তোলিত বালি ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় আরসিসি ব্লক স্থায়িত্ব করার লক্ষ্যে নিক্ষেপ করা হচ্ছে এবং কৃত্রিম চর স্থায়িত্ব করার লক্ষ্যে প্যারাবন সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে ইতোমধ্যে। এছাড়া সরজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায় রাঙ্গুনিয়া কিছু এলাকায় আরসিসি ব্লক তলিয়ে যায়, উক্ত এলাকায় খুব শীঘ্রই রিপেয়ারিংয়ের করা হবে।

কননকৃত (বর্জ্য) বালি অকশন দিয়ে বিক্রি করবে কিনা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ.এম.ডি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ড্রেসিং ইনচার্জ মোঃ হামিদুল ইসলাম বলেন, “কোম্পানির ঊর্ধ্বতম কর্মকর্তা ও প্রশাসনিক কোন জামেলা না থাকলে বালি এখন থেকে কেউ সরাতে পারবে না।

এই সময় উপস্থিত ছিলেন, মোয়াবিনুল ইসলাম মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা হাফেজ মোঃ আমির হোসেন, সরফভাটা ৮নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মোঃ হাশেম, সরফভাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, সরফভাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা খোরশেদ আলম সুজন, ৮নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সাইফুদ্দিন আজম, ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোহাম্মদ খোকন, চট্টগ্রাম ইসলামিক ফাউন্ডেশনে কর্মকর্তা মাওলানা আবুল বয়ান, সরফভাটা ইউনিয়ন আওয়ামী সেচ্ছা সেবক লীগের নেতা মার্শাল টিটু, যুবলীগ নেতা মোঃ মুবিনুল ইসলাম, মোঃ সেলিম, মোঃ রহমত প্রমুখ।

উল্লেখ্য, ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এবং পর্যটননগর খ্যাত পাহাড় ও হ্রদবেষ্টিত কাপ্তাই হ্রদের পানি বৃদ্ধি পেয়ে ভাটি অঞ্চলের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় ব্যাপক ভাঙনের সৃষ্টি হয় কর্ণফুলী নদীতে। পানির স্রোতে এই অঞ্চলের কিছু অংশ প্রতি বছরই ভাঙনের কবলে পড়ে। গত ৩০ বছর ধরে রাঙ্গুনিয়ায় কর্ণফুলী নদীর প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দু’পাড়ে ভাঙ্গনে করালগ্রাসে শতশত একর ধানী জমি ও বসতভিটা দু’পাড়ের শতশত বৃক্ষ পানিতে তলিয়ে গেছে, এতে করে কর্ণফুলী পাড়ে বসবাসকারী প্রান্তিক পর্যায়ের বিরাট একটি অংশ চরম দারিদ্র্যতা ও সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়ে।

জানা যায়, ১৯৮০ সালের পর থেকে কর্ণফুলী নদী ভাঙ্গন শুরু হয় বিশেষ করে সব চেয়ে বেশি সরফভাটা ইউনিয়নে, নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে ইউনিয়নটি ৭ নং ওয়ার্ড মূল ‘ভূমিখীল’ রাঙ্গুনিয়ার মানচিত্র থেকে বিলীন হয়ে যায়। ভূমিরখীলসহ সরফভাটার প্রায় সাড়ে তিন হাজার পরিবারের আনুমানিক ২ কিলোমিটার বসতভিটা ও চাষাবাদের জমিন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। উদ্বাস্তু পরিবার রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম সিটি ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে বসতি করে রয়েছেন।

১৯৯৮ সালে নদী ভাঙ্গন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড গাছের বলদি স্থাপন করে কিন্তু নদীর তীব্র স্রোতে সব বলদি নদীতে তলিয়ে যায়। এর আগে রাঙ্গুনিয়ার সাংসদ মোঃ ইউসুফ নদী ভাঙ্গরের দুর্দশা সংসদে উত্থাপন করলে ব্যাংক রিভিউ গঠন করা হয়েছিল। সেটাও কোন কাজে আসেনি। নদীরতীর রক্ষার যুদ্ধে পরাজয় বরণ করতে হয়। তবে তৎকালীন পানি সম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক এমপি এর দেওয়া প্রকল্পে মোয়াবিনুল ইসলাম মাদ্রাসার রক্ষায় ৫০ মিটার আরসিসি ব্লক স্থাপন করলে অর্ধেক বিলীন হয়ে যাওয়া মাদ্রাসা কোন রকমে কর্ণফুলীর বিষাক্ত ছোবলে থেকে রক্ষা পায়।

২০০৮ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাঙ্গুনিয়া থেকে নির্বাচিত সাংসদ ডঃ হাছান মাহমুদ এমপি’র প্রচেষ্টায় কর্ণফুলী, ইছামতি ও শিলক খালের ভাঙ্গন প্রতিরোধে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্লক বসানো হয়। এরপর সর্বশেষ ২০১৭ সালে কর্ণফুলী নদীর তীব্র ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩৯৮ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। ২০১৮ সালে জানুয়ারিতে শুরু হয় চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট থেকে বেতাগী অংশ পর্যন্ত ড্রেজিং। প্রকল্পের আওতায় কর্ণফুলী নদীর রাঙ্গুনিয়া অংশে ১৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে নদীর ১০ কিলোমিটার খনন করা হচ্ছে। বসুন্ধরা, ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং, ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ও এ.এম.ডি নামের চার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে এ প্রকল্প কাজ হচ্ছে। নদী খনন ছাড়াও পুরো প্রকল্পে নদীভাঙন রোধে ব্লক বসানোসহ নদী শাসনের বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে প্রকল্পের আওতায়।