ই-পেপার | শনিবার , ২৭ এপ্রিল, ২০২৪
×

নতুন বছরের আগেই উন্মুক্ত হচ্ছে নবরূপে সজ্জিত লালদীঘির ময়দান

আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দান। দীর্ঘ বছর অবহেলিত থাকলেও এই ময়দানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছয়দফা সহ বাঙালি জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মৃতি স্মারক। টেরাকোটার কারুকাজে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। ধূসর বালি ময়দানকে মোড়ানো হয়েছে সবুজে সবুজে। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রায় চার কোটি টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়ার পর ইতোমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনও করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরও লালদীঘির ময়দানটি এখনো টিনের ঘেরায় বন্দি! এই ঘেরা কবে উঠবে সেটি জানে না সংশ্লিষ্ট কেউ-ই।

নগরবাসীর এমন প্রশ্নের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পটির উদ্যোক্তা স্থানীয় সংসদ সদস্য ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল জানিয়েছেন— নতুন বছরের আগেই লালদীঘির ময়দান থেকে সরছে টিনের ঘেরা! তবে মাঠ ব্যবহার করে অনুষ্ঠান করতে হলে মানতে হবে বেশ কিছু কঠিন শর্ত। মূলত প্রাধান্য পাবে মুসলিম স্কুলের শিক্ষার্থীরা ও জনগণের হাঁটাচলার জন্য।

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রায় চার কোটি টাকার প্রকল্পটি ২০২০ সালের কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ২০২১ সালে ১০ মার্চ। গত ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের ২৯টি প্রকল্প উদ্বোধনের সময় পলোগ্রাউন্ড মাঠ থেকে ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে এ লালদীঘির মাঠের সংস্কার কাজও উদ্বোধন করেছিলেন।

লালদীঘি ময়দান নামে পরিচিত হলেও সরকারিভাবে এই মাঠটির মালিকানা চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের। সংস্কারের কাজ শুরু হওয়ার আগে এই বিদ্যালয় এবং লালদীঘি এবং আশপাশের এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করতো এই মাঠেই। লালদিঘী ময়দানের রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্বে কারা থাকবে এ নিয়ে জেলা প্রশাসন, চসিক ও স্কুল কর্তৃপক্ষের সম্পৃক্ততা নিয়ে কথা উঠলেও শেষ পর্যন্ত শিক্ষা উপমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের মাঠের নিয়ন্ত্রণ থাকছে সরকারি মুসলিম হাই স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছেই।

চট্টগ্রামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭৬১ সালে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চট্টগ্রামের শাসনভার গ্রহণ করে, তখন থেকেই লালদীঘিকে কেন্দ্র করে এই শহরের যত কর্মচাঞ্চল্য বিস্তার লাভ করে। লালদীঘির পাড়ের চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের দপ্তরটি ব্রিটিশ আমলের। তখন এটি তহশীল দপ্তর ছিল। লাল রঙের সেই ভবনকে চট্টগ্রামের মানুষ ‘লালকুঠি’ নামে চিনত। এই ভবনের পাশে ছিল ‘লালঘর’ নামে একটি কারাগার ভবন। এ দুটি ভবনের পাশে ছিল একটি পুকুর। ব্রিটিশ শাসকরা সেই পুকুরের পরিধি বড় করে সেটাকে দিঘিতে পরিণত করেন। পাহাড়ি টিলার ওপর ‘লালকুঠি’ এবং ‘লালঘর’। আর পাশের দিঘিটির নাম তাই স্বাভাবিকভাবে হয়ে গেল লালদীঘি। তার পাশের মাঠটিকেও ‘লালদীঘি ময়দান’ নামে চিনতে শুরু করল সবাই। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ঘোষণা সময় ২৫ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি ময়দানে প্রথম জনতার সামনে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

চট্টগ্রাম নগরীর ঐতিহাসিক লালদিঘী ময়দান এই বাংলার ইতিহাসের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এই ময়দান থেকেই গর্জে উঠেছে বৃটিশ এবং পাকিস্তানী শাসন বিরোধী নানা আন্দোলন সংগ্রামের হাজারো প্রতিবাদী কণ্ঠের। বাংলাদেশ, ভারতসহ অত্র অঞ্চলের অগুনতি নেতৃত্বের পদচিহ্ন পড়েছে এই লালদিঘীর ময়দানে। ইংল্যান্ডের লর্ডস স্টেডিয়ামকে ক্রিকেটারদের তীর্থস্থান হিসেবে এখানে খেলতে পারা যেমন প্রত্যেক ক্রিকেটারের স্বপ্ন। তেমনি চট্টগ্রামের লালদিঘীর ময়দানও প্রতিটি রাজনীতিকের কাছে তীর্থস্থান। এই মাঠে বক্তব্য রাখতে পারা প্রত্যেক রাজনীতিকের কাছে গর্বের, গৌরবের। যে ময়দান চট্টগ্রামের অনেক ইতিহাসের সাক্ষী।

লালদীঘি ময়দান সংস্কারকারী সংস্থা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার সরকার সিভয়েসকে বলেন, ‘প্রকল্পে কাজ ও উদ্বোধন হয়ে গেলেও কে দেখভাল কোন কোন কর্তৃপক্ষ করবে এই সিদ্ধান্ত আমাদের কাছে আসেনি। এই বিষয়টা সম্পূর্ণ শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেখবে। আমাদের কাজ ছিল ঐতিহাসিক ময়দানের সংস্কার করে দেওয়া।’

এদিকে সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ আক্তার বলেন, ‘সরকারি ভাবে মাঠের মালিকানা মুসলিম হাই স্কুলের। সেই হিসাবে দেখভালের দায়িত্ব আমাদের পাওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের কাছে এখনও কোন নির্দেশনা আসেনি।’

কবে উন্মুক্ত হচ্ছে এবং কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে নবরূপে সজ্জিত লালদীঘির মাঠ? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকল্পটির উদ্যোক্তা স্থানীয় সংসদ সদস্য ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল সিভয়েসকে বলেন, ‘নতুন বছরের আগেই যে কোন সময় উন্মক্ত করা হবে লালদীঘির ময়দান। তবে মাঠ ব্যবহারে মানতে হবে বেশ কিছু কঠিন শর্ত। মূলত প্রাধান্য পাবে মুসলিম স্কুলের শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা ও মানুষের হাঁটাচলা।’

চট্টগ্রামের লালদিঘীর ময়দানও প্রতিটি রাজনীতিকের কাছে তীর্থস্থান। এই মাঠে বক্তব্য রাখতে পারা প্রত্যেক রাজনীতিকের কাছে গর্বের, গৌরবের। তাহলে সেই লালদীঘি ময়দানে আর কোন জনসভা হবে না? এমন প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষা উপমন্ত্রী বললেন, ‘স্কুলের অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা যাবে। বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে জনসভা করতে হলে সেখানে মানতে হবে বিশেষ স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর।’ রক্ষাণাবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য নওফেল বলেন, ‘এটি যেহেতু মুসলিম স্কুলের মাঠ তাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। রক্ষণাবেক্ষণসহ নিরাপত্তার বিষয়টি স্কুল কর্তৃপক্ষ দেখবে। মাঠে আনসার সদস্য নিয়োগ দেওয়া হবে।’

গত ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের ২৯টি প্রকল্প উদ্বোধনের সময় পলোগ্রাউন্ড মাঠ থেকে ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে এ লালদীঘির মাঠের সংস্কার কাজও উদ্বোধন করেছিলেন। তবে নবরূপে সাজানো ঐতিহাসিক ময়দানটি যখন উন্মুক্ত করা হবে তখন কোন অনুষ্ঠান করা হবে কিনা জানাতে চাইলে এর উদ্যোক্তা নওফেল বলেন, ‘যেহেতু এটির উদ্বোধন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একবার করেছেন তাই আর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের কথা না। এটা নতুন বছরের আগেই যে কোন একদিন উন্মুক্ত হয়ে যাবে। অনুষ্ঠান করতে গেলে একদিনেই হাজার হাজার মানুষ আসবে। তাতে মাঠের সমস্যা হবে।’