
নতুন বই পেলে সবসময় আনন্দ হয় আমার। ভেতরে বয়ে যায় সীমাহীন খুশির বন্যা। আলোকলতার মতো লম্বাটে রূপরেখা নিয়ে বয়ে উঠি বইয়ের এপাতা থেকে ওপাতা, শব্দ থেকে শব্দান্তর, প্রতিটি শাখা প্রশাখায়। স্কুল বা কলেজ লাইফে প্রেম-টেম হইলো না আমার। ফলত প্রেমিকা যা হয় হচ্ছে সব’ই লেখক লেখিকাদের বইপুস্তক। ছড়া কিংবা কাব্য, গল্প কিংবা উপন্যাস আদতে সবকিছুই মনোযোগ দিয়ে না পড়লে একজন সুসম্পন্ন ও প্রকৃত পাঠক হওয়া সম্ভব নয়।
একজন প্রকৃত পাঠকের পাঠে অবশ্যই উঠে আসতে হবে লেখকের লেখনী সম্পর্কে লেখকের সৃষ্টি সম্পর্কে ভালোমন্দ। আমার আলোচনার হাত ওতোটা প্রসার নয়। কিংবা রেষের টগবগে ঘোড়ার মতো ওতোটা চঞ্চল আর দ্রুতগামী নয়। ধীর এক যাযাবর, যার মধ্যে পাওয়া যায় খুনসুটি ব্যাপার। ছোটগল্প আমি একদম অল্পই পড়েছি। ধরা চলে হাতেগোনা কয়েকটি বই। উপন্যাসও যে অনেক পড়েছি তা নয়, আসলে বেকার ফেকার মানুষ হলে যা হয়। পড়তে ‘তো ইচ্ছে হয় অনেক বই অথচ কেনার পয়সা তেমন জোগাড় হয় না। এর ওর কাছ থেকে ধার উপহার আর মাঝে-সাঝে দু-চারটে যা কিনি এই নিয়ে আমার পাঠরত সংসার।
যেকথা বলছিলাম,ছোটগল্পে গদ্যের মতো স্বাদ না পাওয়া গেলে পাঠে মন বসে না। ফলত এই সময়ে এখন অবদি নির্ঝর’দার বইছাড়া যে কয়েকটি ছোটগল্পের বই নিয়ে বসেছি সম্পূর্ণ শেষ করতে পারিনি বা করা হয়নি। শরীরে বইছে এখন হালকা গরম হালকা শীত। পূবের নদীর জলের মতো, উপরে গরম নীচে ঠাণ্ডা। আমার মা সবসময় বলে অ’বাপ এতো পড়িস ক্যা? পড়তে পড়তে’তো চুল পাকাইয়ে ফেললি। মায়ের কথায় কান দেই না। পড়ি যেমন যতটুকু। এবার আমার ঘরে এলো ইমরুল কায়েস এর বউনটী। নব ভাবনা থেকে প্রকাশিত বইটি আমি উপহার পেয়েছি। তো দুচারদিন বিড়ম্বনা হলেও বইটি ঘরে এলো অবশেষে। বইটি পাওয়ার আগে আমি অবশ্য দিপংকর মারডুকের পাঠানো লোক লিটল ম্যাগাজিন কবি আওলাদ হোসেন ক্রোড়পত্র পড়ছিলাম। কী দারুণ আওলাদ হোসেনের লেখাগুলো। সুখী স্বভাবের মানুষটা একদিন দুঃখী হওয়ার জন্য লালনের মতো ছাড়লেন সব। আওলাদ সরকারি চাকরি, বাড়ি-গাড়ি, বউবেটি সন্তান সব ছেড়ে নামলো পথে কবি হওয়ার নেশায় কবিতার পথে। মাথায় কবিতার সংসার এক মস্ত সংসার, শব্দরা খেলা করে। এই শব্দ নিয়েই কবি ঘুরতে লাগলেন ময়মনসিংহ শহরের অলিগলি।
আজ এই আলোচনা যদিও আওলাদ হোসেন’কে নিয়ে নয়, তবু্ও মন থেকে বেড়িয়ে গেল দু-চারটে বয়ান। আদতে কবিতা ববিতা ছাড়া আমার মাথায় অন্য কিছু লেখার আইডিয়া তেমন আসে না। তাই কবিতার কিতাব সবচাইতে বেশিই পড়েছি। যেকথা লিখতে বসেছি। গল্পকার ইমরুল কায়েসের বউনটী নিয়ে স্বল্পকিছু কথা। ২২ ‘টি ছোটগল্প নিয়ে নির্মিত বউনটী বইখানা। নাম নির্বাচনের ব্যাপারে লেখককে সাধুবাদ জানাই। সুন্দর সাবলীল এক নাম, যা প্রায় প্রতিটি গল্পের প্যাটার্নের সঙ্গেই ওতোপ্রোতভাবে মিশে যায়। তবে পাঠ বিষয়ে এসে পাঠক হিসেবে বলতে পারি এই গল্পগুলো আরো মোটাতাজা কিংবা চওড়া হতেই পারতো। আসি গল্পের ভাজে। পাতায় পাতায়, শব্দে শব্দে। ইমরুল কায়েসের প্রথম গল্পগ্রন্থ বউনটী। অথচ প্রথম বইতেই দেখিয়েছেন তার হাতের মুনশিয়ানা। পাঠককে গল্পের গভীরে আরও কিছুটা ডুবে রাখার ভাবনা গেড়ে দেওয়া যেত গল্পের চরিত্রে মেটাফরে।
কিছুদিন আগে লেখক সেলিম মোরশেদ নামক একজন প্রবীণ ছোটগল্পের বই নিয়ে একটা সুন্দর আলোচনা করেছিলেন। পড়লাম কী দারুণ কী দারুণ। সেই তাগিদেই ইমরুল কায়েসের বউনটী নিয়ে আগ্রহের সঙ্গে বসা। বউনটী পড়ে আমার স্কুলকালের বন্ধু ইসমাইলের সঙ্গে গল্পের গঠন নির্মাণ কৌশল নিয়ে আলোচনা করছিলাম ব্রিজে বসে। বন্ধু’তো বইয়ের নাম শুনেই অবাক। বন্ধুর মতে এমন বই সবার পড়া উচিৎ। গল্প’তো ছোট’ই হয় কিন্তু ইমরুল কায়েসের বউনটী বইয়ের কিছু গল্প এতো ছোট যে ওগুলোকে আমি বরং অণুগল্প বলতে চাই। গ্রামীণ জীবন নানাবিধ টান-পোড়ন প্রেম কাম ও দাগ কাটা বিরহও উঠে এসেছে বউনটী বইয়ের গল্পের পরতে পরতে। সমকালীন লেখকের হাতে তার সময় সবসময়ই বিদ্যমান।
লেখক ইমরুল কায়েস খুব পারদর্শীভাবে গল্পের ছকে ছকে তুলে ধরেছেন বিশ্বময়ী করোনা ভাইরাসের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া মানুষের যাপিত জীবনের ব্যক্ততা। ফাদার তেরেসা এই গল্পটাকে বলব মানবতাময়ী এক গল্প। গল্পের সামান্য অংশ– ❝আচ্ছা লাশ দাফন করাটা তো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। চলেন দুজনে কবরটা খুঁড়ে ফেলি। কাউন্সিলসহ শফিক কবরস্থানে ঢুকে আধখোঁড়া কবর খুঁড়ে ফেলে। ড্রাইভার মজনুকে বলে এ্যাম্বুলেন্সটা কবরের কাছে নিয়ে আসতে, পারবে কি না। মজনু গাড়ি স্ট্যার্ট করে এ্যাম্বুলেন্সের ব্যাক গিয়ার দিয়ে পেছনের ব্যাক ডালা একদম কবরের কাছে নিয়ে যায়❞।
এই করোনার ক্লান্তিকালে মানুষ মানুষের পাশে থাকে কে? ফাদার তেরেসা গল্পে লেখক ইমরুল কায়েস দেখিয়েছেন মানুষ মূলত মানুষের জন্য। করোনায় মৃতলাশ দাফন রেখে সবাই যখন পালিয়ে যাচ্ছে। গল্পের মোরাল শফিক সাহেব ঘোর করোনার মধ্যে মানুষের এমন বিপদ দেখে সে নিজেই এগিয়ে আসে। (সংক্ষিপ্ত) একে একে সব গল্প’ই পড়েছি বইয়ের। লেখক ইমরুল কায়েস বইটা যে গল্প দিয়ে শুরু করেছে সেই গল্প নিয়ে সামান্য বলি– কেরামত মাঝির নিশিরাণী” গল্পটি মূলত গ্রামীণ জীবনের এক সুনির্মান অকপট। মোবারক মাঝি যে কি-না অনেক সাধনা করে পাওয়া করিমন নেছার একমাত্র পুত্রসন্তান। আঞ্চলিক ভাষার এই গল্পটিতে আছে ঝারফুক পীর কুতুব পানিপড়া পিতল তামা কাঁসা লোহা দিয়ে তৈরি করা তাবিজের গল্প ও নানাবিধ কুকর্মের ঐতিহ্য প্রথা। গল্পের কাহিনী বিশ্লেষণ করে দেখা যাবে, এর মেটাফর আমাদের ফেলা আসা কূলবাঙা নদী জীবনের কথা।
বাদামতলী ঘাটে কেরামত মাঝি নৌকায় বসে বসে বিড়ি ফুকে কোনো যাত্রী নেই। হঠাৎ এক নতুন দম্পতি হাক ছাড়ে পলাশ ডাঙা যাওয়ার আহ্বানে। কেরামত মাঝির নিশিরানী গল্পের কাহিনী এখান থেকেই গভীরে পা বাড়ায়। পলাশ ডাঙা যাওয়ার পথে একদল ডাকাত এসে পাকড়াও করে কেরামতের নৌকা। কেরামত প্রাণ বাঁচাতে নদী সাঁতরিয়ে ওঠে নদীঘেঁষা এক বনে। ওদিকে নৌকায় ডাকাতদল নব স্ত্রীকে রেখে স্বামীকে মারধর করে ফেলে দেয় নদীতে। এবং ডাকাত সরদার স্ত্রীলোকটিকে নিয়ে উল্লাস করতে থাকে। প্রাণ বাজাতে কেরামত মাঝি নৌকা থেকে ঝাপ দিয়ে সাঁতরায়ে সাঁতরায়ে কূলে এসে অন্ধকারে জঙ্গলের পথ হাটতে হাটতে সম্মুখীন হয় পুরনো আমলের এক বাড়ি দোরগোড়ায়।
লেখক এই বাড়িতেই সুকৌশলে রেখে দিয়েছে গল্পের নায়ক কেরামত মাঝির নিশিরানীকে। বউনটী’তে লেখক কিছুটা স্মৃতিচারণ ভাষাও গুজে দিয়েছেন গামছা গল্পটিতে। কী সুবিমল গল্প। গামছার জন্য একটা মানুষ লাশ হয়ে গেল। এই গল্পটি যখন পড়া হলো, মনে হলো ঘটনাটি আমার চোখের সামনে ঘটেছে কোথাও। মানুষ প্রতিনিয়ত বদলায়। বদলায় মানুষের প্রেম ভালোবাসা আকাঙ্খা। মানুষ যে রাতারাতি বদলে যেতে পারে রাত উদাহরণ স্বরূপ লেখক বইয়ের দ্বিতীয় গল্প জলের বিছানায় তুলে ধরেছেন দীর্ঘ প্রেমের ইতিকথা। শব্দ বিন্যাসে লেখক সুন্দর সাবলীল ধারা প্রয়োগ করেছে। ফলত পাঠে একরকম ফুরফুরা ব্যপার লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও বইয়ের কাজ ও বর্ণ বণ্টন নজরকাঁড়া। গল্পের ধারা ও ধারাপাত চলমান থাকলে লেখক ইমরুল কায়েসের আরও সুসম্পন্ন উন্নতশীল মানসম্মত বই আশা করা যায় আগামী দিনগুলোতে। আল নোমান ভাইয়ের সুন্দর প্রচ্ছদে বইটির মূল্য ২৫০ টাকা।
লেখক :কবি