ই-পেপার | শুক্রবার , ১৯ এপ্রিল, ২০২৪
×

ধর্ম পরিচয়ের বেড়াজালে আটকে আছে নিহত যুবকের লাশ

চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়া মনসা বাদামতল এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়া (রতন দাশ) নামের ২৯ বছর বয়সী যুবকের মরদেহটি আরো একমাস চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে থাকবে। হিন্দু নাকি মুসলিম এই পরিচয়ের বেড়াজালে আটকে থাকা লাশটির ধর্ম পরিচয় নিশ্চিত করে আগামী ২০ এপ্রিলের মধ্যে পুলিশি তদন্ত রির্পোট জমা দেয়ার জন্য পটিয়া সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নির্দেশ দেন। বুধবার সকালে পটিয়া সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক বিশ্বেস্বর সিংহ এ আদেশ দিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন আদালতের জিআরও রফিকুল ইসলাম।

এর আগে, গত ৩০ জানুয়ারি পটিয়ার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মার্চের ১৩ তারিখের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিশ্বেশ্বর সিংহ। কিন্তু ১৩ মার্চ আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেননি হাইওয়ে থানা পুলিশ। সেদিন তারা আবারো অধিকতর তদন্তের জন্য সময়ের আবেদন করে আদালতে একটি আবেদন জমা দিয়েছেন। পটিয়া হাইওয়ে পুলিশের সময়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে বুধবার আদালত এ আদেশ দেন।

উল্লেখ্য, গত ২৯ জানুয়ারি দুপুর ২টার দিকে পটিয়া উপজেলার মনসা বাদামতল এলাকায় তেলবাহী লরির চাপায় পিষ্ট হয়ে মোটরসাইকেল আরোহী ওই যুবকের মৃত্যু হয়। এদিকে, নিহত যুবকের মা সন্ধ্যারানী দাশ শুরু থেকেই দাবি করে আসছিলেন রতন দাশ হিন্দু ছিলেন। তাই হিন্দু ধর্মের নিয়ম মেনে শেষকৃত্য চিতায় সম্পন্ন করতে চান। কিন্তু তার সহপাঠীদের দাবি, তিনি ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর চট্রগ্রামের লালখান বাজার এলাকার একটি মাদ্রাসায় মৌলানা হারুন এজাহারের কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এরপর থেকে তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন ও ইসলাম ধর্মের সব নিয়মকানুন মেনে চলতেন। তাই তারা মুসলিম হিসেবে তার লাশ দাফন করতে আগ্রহী। এজন্য সব ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে হাইওয়ে থানার তদন্তকারী কর্মকতার্র কাছে জমা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন হাফেজ ক্বারী আকরাম হোসাইন।

জানা যায়, নিহত যুবক তার মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় মুসলিম হওয়ার পরও তার মাকে নিয়ে নগরীর একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। করতেন আগ্রাবাদ এলাকায় একটি মোবাইল এক্সোসরিস প্রতিষ্ঠানে চাকরি। আর তার মৃত্যুর পরেই এখানেই বাধে বিপত্তি। তার মৃত্যুর দেড় মাস পাড় হয়ে গেলেও এখনো আদালতের রায়ের অপেক্ষায় নিহত যুবকের পরিবার ও সহপাঠীরা। আরো একমাস পাঁচ দিন পর জানা যাবে লাশটি কবরস্থানে যাবে, নাকি চিতায় পোড়ানো হবে?

এদিকে হলফনামা সূত্রে জানা গেছে, ওই যুবকের নাম রতন দাশ (২৯)। বাড়ি মিরসরাই উপজেলার পূর্ব মায়ানী গ্রামে। তার পিতার নাম মনোরঞ্জন দাশ ও মাতার নাম সন্ধ্যা রানী দাশ। নিহত যুবক দুই বছর আগে মুসলিম হিসেবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে নাম পরিবর্তন করে আহমাদ নাম হয়েছেন। যার নোটারী নম্বর-১১০৫৪৪। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার বেশ কিছু ছবিও রয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে পরিবার ও তার সহপাঠিদের মধ্যে বিপত্তি ঘটলে উভয়পক্ষ আর হাইওয়ে পুলিশে আদালতের দ্বারস্থ হন।

নিহত যুবকের সহপাঠী সিরাজুল মাওলা মিলাদ জানান , সে মনে প্রানে ইসলাম ধর্ম মেনে মুসলিম হয়েছে। আমরা সহপাঠীরা তার মৃত্যুর পর সে যে মুসলিম হয়েছে তার সব ধরনের কাগজপত্র সংগ্রহ করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছি। আমরা মনে করেছিলাম ১৩ মার্চ আদালতের দেয়া সময়ের মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত রির্পোট জমা দিবেন। কিন্তু সেদিন আমরা পটিয়া আদালতে এসে জানতে পারি পুলিশ আবেদন করে আরো সময় চেয়েছেন। তাতেই আমরা হতাশ হয়েছি। আমরা রাষ্ট্রের কাছে আবেদন করছি এ মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করে যেন আমরা আমাদের বন্ধুকে কবরস্থ করতে পারি।

নিহতের মা সন্ধ্যা রাণী দাশ , আমি ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছি। পুলিশকে ফোন করলে তারা আমাকে বলেন কিছু হলে আমাকে তারা জানাবেন। এখন সবকিছু তো সরকার আর আদালতের জিন্মায় চলে গেছে। আমি আর কি করব। আদালত যা সিদ্ধান্ত দিবে তাই হবে আরকি। আমি মহামান্য আদালতের কাছে আশা করছি আমার ছেলের লাশ আমার কাছেই ফিরিয়ে দিবেন এমনটাই বিশ্বাস তার।

হাইওয়ে থানার ওসি স্নেহাংশু বিকাশ সরকার জানান, চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি এখনো তদন্তাধীন আছেন। আমাদের তদন্ত কর্মকর্তা নিহতের ধর্মীয় পরিচয় নিশ্চিত করতে তার গ্রামের বাড়ি ও শহরে যে এলাকায় অবস্থান করতেন সেখানে গিয়ে সবার সাথে কথা বলে নানা তথ্য উপাত্ত জানার চেষ্টা করছেন। অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা আদালতে তদন্ত রির্পোট জমা দিতে পারব। এরপর আদালত সিদ্ধান্ত দিবে লাশটি কি কবরস্থানে যাবে নাকি চিতায় যাবে।

মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ পরিদর্শক রুহুল আমিন জানান , মামলাটির দায়িত্ব ভার হাতে নিয়েছি আমি গত ১৬ ফেব্রুয়ারী। এরপর যেখানে যেখানে যাওয়া লাগছে সেখানে গিয়ে আমি বুঝতে পেরেছি হিন্দু ও মুসলিম দু’পক্ষই লাশটি নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় আছেন। পরবর্তীতে আমি সিনিয়রদের সাথে কথা বলে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য আরো সময়ের প্রয়োজন মনে করে ১৩ মার্চ আদালতে সময়ের আবেদন করেছি। আমি আশা করছি আদালত পরবর্তী যে দিন তারিখ নির্ধারন করে দিয়েছে সে সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে পারব।

অপরদিকে, সড়ক আইনে নিহত যুবকের মা সন্ধ্যা রানী দাশের দায়ের করা মামলাটি প্রধান আসামি ঘাতক ট্রাক চালক শাহাদাত হোসেন সিকদার প্রকাশ বাবুল ড্রাইভার (৪২) গত ২৭ ফেব্রুয়ারী আদালতে জামিন আবেদন করলে আদালত তার জামিন না মন্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সে সাতকানিয়া উপজেলার পুরান নগর এলাকার আবুল হোসেন সিকদারের ছেলে। এখনো সে কারাগারে আছে এবং তেলবাহী গাড়িটিও আটক আছে পটিয়া হাইওয়ে থানা পুলিশের কাছে।